বিশ্বজিৎ মন্ডল- অতীতে আমাদের গ্রাম এলাকায় প্রতি সপ্তাহে প্রতি মাসে শিলকাটাও শিলকাটাও বলে এরকম শব্দ শোনা যেতো। আর তা হলো শিল কাটনিওয়ালা পাথর কেটে তার উপর সুন্দর করে খোদায় করে দিতো। যা আমাদের রান্না ঘরের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয। বিভিন্ন ধরনের মসলা বাটতে, চাল বাটতে, ডাল বাটা সহ নানান ধরনের কাজে। আস্তে আস্তে এ পেশাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। তার পরেও কিছু কিছু মানুষ প্রাচীন আমাদের পুরনাতন ঐতিহ্য সেসব পেশাকে আগলে রেখেছে। আর তা দিয়ে তারা পরিবারের আয়ের পথ খুজে। ঠিক তেমনি একজন মানুষ হলো সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের নুরনগর গ্রামের প্রবীন মতিয়ার রহমান (৭৬)। অতীতের মতো সে এখনোও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে যেযে শিল কাটা, নোড়া কাটা ও গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি দা, কুড়াল, কদাল ছুরিতে সান/ ধার দেওয়ার কাজ করে চলেছেন্।
মতিযার রহমানের ২ ছেলে তারা সব পৃথক।তিনি আর তার স্ত্রী ও দুই পুত্নী সহ চার জনের সংসার। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বয়সে কেনো এই কাজ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ কাজটি করতে আমার ভালো লাগে। বিভিন্ন স্থানে যেতে পারি বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতে পারি। আর শিলের গায়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে খোদাই করে আলাদা একটু শান্তি পাই। যে কারণে এই বয়সে আমার আয়ের জন্য এ পথটিকে সঠিক এবং উৎকৃষ্ট বলে আমি মনে করি। আর এই কাজটি করে কোন রকমে আমাদের ৪ জনের সংসার চলে যায়। কোন কোন সময় আমি একাজ করতে বাহিরে ৪-৫ দিন থাকতাম। এছাড়াও দিনে কোন না কোন দিন যেসব বাড়িতে কাজ করতাম তারা দুপরে খেতে দিতো। কিন্তু এই দিনটা যেনো হারিয়ে যেতে বসেছে।“
কারণ হিসাবে তিনি বলেন যে, “বর্তমান সময়ে যে সারা বিশ্ব করোনা করোনা করে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর এতে করে আমরা যেসব পেশাজীবীরা পেটের টানে খাদ্য যোগান দেওয়ার জন্য বাহিরে বের হই তারাই বিপদে পড়েছি। একদিন কাজ না করলেই আমাদের সংসার চলে না। আর এখন তো সব বন্ধ। যদিওবা হাট বাজার, দোকান পাট, ব্যাংক সহ সব ধরনরে অফিস ছোট আকারেও খুলছে। কিন্তু আমাদের তাতে কি? আমরা কাজের জন্য বাহিরে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। আমি যে শিল কাটার কাজ করি। আর এ কাজে আগে মোটে না হোক দিনে ৩০০ টাকার উপরে আয় না করে বাড়ি আসতাম না। আর এখন মানুষের দুয়ারে দুয়ায়ে শিল কাটাও শিল কাটাও, দা বটিতে ধার দেবেন নাই এরকম চিৎকার করলেও মানুষ যেনো আর ডাক শুনছেনা। আগের যেসব পরিচিত বাড়ি ছিলো সেসব বাড়িতে আগে হরহামেশেই ঢুকতে পারতাম কিন্তু এখন গেলে নানান ধরনের প্রশ্ন কেন আসলেন? দেশের কি অবস্থা? তা কি জানেননা? আমাদের বাড়িতে এখন আর ঢুকবেন না। এরকম নানান ধরনের প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে। আগে যেসব বাড়িতে কাজে গেলে একবেলা একমুটো খেতে দিতো। তারাই এখন তাদের বাড়িতে যেতে নিশেধ করে। এখন সারা দিন কাজ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরেও ১০০ টাকা জোগাড় করা যেনো খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরো বলেন যে, বয়স হয়েছে তার পরেও নিজের পেশাকে টিকিয়ে রাখা সংসারের কথা মাথায় রেখে বাহিরে যাচ্ছি। কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছে না। যে সান দেওয়ার কাজ করি সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে নতুন করে একটা সান কেনা দরকার তাও কিনতে পারছিনা।ঘরের মধ্যে পানি পড়ছে নিজেদেরে পোশাক ওক্রয় করতে পারছিনা। এই করোনা এসে আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একদিকে করোনা অন্যদিকে বর্ষাকালের বর্ষা। আবার এখনকার মানুষ যেনো আর আগের মতো এসব জিনিষ ব্যবহার করছেনা। এখন নানান ধরনের ইলেকট্রনিক্স জিনিষ এর ব্যবহার করছে তারা। সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্য়োগ মোকাবেলা করতে পারতাম আমরা। কিন্তু এই করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে আমরা শুধু পিছনের দিকে যাচ্ছি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যেনো কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা। করোনা আমাদের জীবন জীবিকা আটকে দিয়েছে! আটকে দিয়েছে আমাদের পেশার কাজকে। কি হবে আমাদের আগামীর দিন! কিভাবে চলবো তা ভাবতেই হতভম্ব হয়ে পড়ছি।
বর্তমান সময়ে যেমন আমাদের পেশা ঐতিহ্য অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আবার কিছু কিছু এখনো টিকে আছে। যা তাদের বংশপরমভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। নানান সময়ে নানান ধরনের দূর্য়োগের কারণে পেশা বিলুপ্ত হচ্ছে। নানা ধরনের দুর্য়োগের সাথে বর্তমান সময়ে মহামারী করোনা সারা বিশ্বের মানুষকে পিছিয়ে দিয়েছে। আর এ পিছিয়ে পড়ার মধ্যে সব থেকে এগিয়ে আমাদের পেশাজীবী জনগোষ্ঠী। যারা প্রতিনিয়ত তাদের নিজেদের প্রয়োজনে কাজের সন্ধ্যানে বাহিরে বের হলেও সঠিক ভাবে মিলছে না তাদের কাজ। এতে করে তারা হতাশা গ্রস্থ হয়ে পড়ছে। নিজেদের পেশাকে টিকেয়ে রাখা যেনো তাদের কাছে দুর্বিসহ হযে পড়ছে। হঠাৎ করে নতুন পেশায় যোগ দিতে পারছেনা বা মানিয়ে নিতে পারছেনা। সেরকম আমাদের শিল কাটা মতিযার রহমানের মতো অনেকেই করোনা দুর্য়োগের মধ্যে নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে দিনপাতিত করছে। এই করোনা মহামারী কালে পেশাজীবী জনগোষ্টীর পেশা টিকিয়ে রাথতে সুশিল সমাজ, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সহায়তা দরকার। সাথ সংকট কালীন সময়ে তাদের জন্য কোন মাসিক ভাতা বা কার্ডের মাধ্যমে তাদের খাদ্য নিশ্চিৎ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। সেই সাখে সকল শ্রেনী পেশার মানুষ সবার সচেতনতায় আমাদের করোনা দুর্য়োগ থেকে রক্ষা পাওযার একমাত্র উপায় হতে পারে।
Leave a Reply